11/11/2023
হিন্দুধর্মের একটি প্রধান সমস্যা হলো-দীক্ষা। খ্রীষ্টান, মুসলমানের মতো হিন্দুদের জন্মের পরেই দীক্ষার ব্যবস্থা নেই, যার ফলে হিন্দুরা জন্ম থেকে নামে হিন্দু, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অনাথ। এর ফলে হিন্দুদের মধ্যে যুক্তিবাদ, উন্নত দার্শনিক চিন্তাভাবনা তথা মানবিকতার বিকাশ হয়েছে এও সত্য। তাদের খ্রীষ্টানদের মতো গির্জাঘরে প্রত্যেক রবিবারের ধর্মসভায় ধর্মান্তর করার পাঠ পড়তে হতে হয় নি, বা মুসলমানদের মতো মাদ্রাসাতে ব্রেইন ওয়াসডও হয় নি। ধর্ম হিন্দুদের কাছে স্বেচ্ছাধীন, ফলে তারা নিজের মতো করে ধর্মকে বুঝেছে, চিনেছে ও পালন করতে পেরেছে। কিন্তু এতে লাভের থেকে ক্ষতি হয়েছে বেশি। খ্রীষ্টান বা মুসলমানদের একটা ধর্মীয় লক্ষ্য আচ্ছে, যা তাদের জাতিকে এক করে রেখেছে। হিন্দুদের এই একতা দৃষ্টিগোচর হয় না। কারণ হিন্দুদের ধর্মীয় লক্ষ্য বলে কিছু নেই, সেটা ব্যক্তিবিশেষে পৃথক পৃথক।
দীক্ষার প্রয়োজনীয়তা হিন্দু ব্রাহ্মণ সন্তানের খুব একটা পড়ে না। কারণ, হিন্দু ব্রাহ্মণরা উপনয়নের মাধ্যমে গায়ত্রী মন্ত্র উপদিষ্ট হয়। ফলে, খ্রীষ্টান, মুসলমানদের মতো তারা একটা পালনীয় ধর্ম প্রাপ্ত হয়, যা অব্রাহ্মণ হিন্দুরা পায় না। “পালনীয় ধর্ম” কি?
এই যেমন খ্রীষ্টান সন্তান জন্মাবার পর বাপ্টিসমের মাধ্যমে খ্রীষ্টধর্মে উৎসর্গীত হয়, মুসলমানরা খতনার মাধ্যমে। অনেকটা আমাদের অন্নপ্রাশনের মতো। যদিও অন্নপ্রাশনের উদ্দেশ্য ভৌতিকঃ সন্তানের মঙ্গল, বৃদ্ধি ও সুরক্ষা, অহিন্দু পূর্বোক্ত সংস্কারগুলির উদ্দেশ্য কিন্তু আধ্যাত্মিক-পরমেশ্বরের সাথে যোগ স্থাপন করা। কিন্তু যেহেতু সেই যোগ অতিশৈশবে ব্যক্তিস্বাধীনতার পাওয়ার পূর্বে হয়েছে, তাই সে যোগ শিথিল। সেই যোগকে শক্ত করতে খ্রীষ্টানদের হয় হস্তার্পণ অনুষ্ঠান বা কনফার্মেশন। এই কনফার্মেশনের মাধ্যমে খ্রীষ্টান সন্তান খ্রীষ্টযাগ বা সাক্রামেন্ট গ্রহণের উপযুক্ত ও প্রাতিষ্ঠানিক খ্রীষ্টান ধর্মের মানুষ হয়ে হয়ে ওঠে। প্রতি রবিবার তার কমিউনিয়নে যোগ দিতে হয়, বিশেষ দিনে উপোস করতে হয়, ও কিছু ব্যক্তিগত সাধনা। মুসলমানদের এই প্রথা কলমা নামে পরিচিত। তবে, বর্তমানে ছেলে মেয়েরা একটু পড়ালেখা জানলেই তাদের কলমা পড়িয়ে মুসলমান করা হয়। শুধু খতনা মুসলিম হতে গেলে যথেষ্ট না।
হিন্দুদের এইসব নাই। তাদের জন্মানোর পর ষষ্ঠীপুজো, খুববেশি হলে নামকরণ ও তারপর অন্নপ্রাশন। এখন আবার অন্নপ্রাশন, নামকরণ একসাথে হয় খরচা বাঁচাতে। আগে বিদ্যারম্ভের একটা সংস্কার ছিলো, এখন সেটা সরস্বতী পুজোর দিন হয়। এছাড়া হিন্দু জাতকের আর কোনো সংস্কার নেই বিয়ের আগে অবধি। এর কোনোটিই আধ্যাত্মিক সংস্কার নয়, সবটাই জাগতিক বিভিন্ন প্রথা। সাধনা শুধু হিন্দু ব্রাহ্মণরাই পেয়েছে, অব্রাহ্মণ হিন্দুর সাধনার অধিকারটুকুও নেই। হিন্দু ব্রাহ্মণরা কিছু না হলেও নিত্য গায়ত্রী জপ করার মাধ্যমে শুদ্ধ, যা থেকে অব্রাহ্মণ হিন্দুরা বঞ্চিত। ফলে ভারতবর্ষের মতো বিশালকায় ধর্মপিপাসু দেশে ধর্মপালন থেকে বঞ্চিত বহু হিন্দু সন্তান। ফলে, আধ্যাত্মিক দীক্ষার গুরুত্ত্ব বেড়ে যায়। কিন্তু সেখানেও বহু সমস্যা আছে।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় সংস্থাগুলি, যেমন শঙ্কর পরম্পরা, কিংবা রামানুজ, মধ্ব প্রমুখ, অব্রাহ্মণদের দীক্ষা দেন না। যদিও বা দেন তা সাধনপদবাচ্য না; অর্থাৎ সাধনা সংক্রান্ত উচ্চতর সংস্কার অব্রাহ্মণরা পায় না। ফলে, দীক্ষার জন্য বহু গুরুর উত্থান ও মঠমিশনের উত্থান ঘটে যারা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে, হিন্দু ধর্মের এই বিশাল ঘাটতিকে পূরণ করতে।
ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশন, কৈবল্যধাম আশ্রম, সৎসঙ্গ, আর্যসমাজ আদি বহু ধর্মপ্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে উপদেশ দীক্ষার মাধ্যমে আপামর হিন্দুকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ধর্মের তথা অধ্যাত্মজগতের ছায়াতলে আনতে। যা অত্যন্ত সুলভ কিন্তু আবার একই সাথে নিন্দিত। কেন নিন্দিত? স্ট্যাটাসের কারণে নিন্দিত। এটা বুঝতে গেলে দীক্ষা নিয়ে একটু বুঝতে হবে, যে হিন্দুধর্মে দীক্ষাপ্রণালী আসলে কিরকম।
দীক্ষা বহুবিধ-উপদেশ দীক্ষা, কলাবতী দীক্ষা, ক্রিয়াবতী দীক্ষা, ক্রম দীক্ষা ইত্যাদি।
উপদেশদীক্ষা হলো সদ্গুরু কর্তৃক নাম বা বীজাক্ষর উপদেশ। সদ্গুরু শিষ্যের কানে নামমন্ত্র বা বীজমন্ত্র দিলে উপদেশ দীক্ষা হয়। উপদেশ দীক্ষার প্রাথমিক নিয়ম হলো জপ করা। জপ ছাড়া পুজো আচ্ছার অধিকার উপদেশ দীক্ষায় মেলে না। তবে, উপদেশ দীক্ষার গুরুত্ত্ব অপরিসীম। বলা হয়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেউ মন্ত্রোপদেশ দিয়ে দিলে তা কার্যকরী হয় শিষ্যের জপ-সাধনার উপর। যেমন হরিদাস ঠাকুর মুক্ত ভাগবত সভায় হরিনাম শুনে নিত্য তিনলক্ষ্ জপ করতেন, আবার একলব্যও কিন্তু ঝোঁপের আড়ালে থেকে দ্রোণের শিক্ষা শুনে শুনে লুকিয়ে নিজে চর্চা করে সিদ্ধ হয়ে হয়েছিলেন। অতি ক্রুর ব্যাধ ভ্রুশুণ্ডি মুদ্গলের কাছে তারকব্রহ্ম গণেশ মহানাম লাভ করে স্বয়ং জীবদ্দশায় গণপতি সারূপ্য পেয়েছিলেন। যার জন্য বহু সাধক উচ্চকণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ করে পূজা করেন না, এতে কেউ শুনে মন্ত্র চর্চা করলে দীক্ষার পূর্ণ ফল সে প্রাপ্ত হয়। বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশন, কি কৈবল্যধা্ম, কি ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘ সর্বত্র উপদেশ দীক্ষার চল আছে। তবে উপদেশ দীক্ষার শক্তিকে কাজে লাগিয়েই পরবর্তী বহু আচার্য্য সাধককে পূজার অধিকারও দিয়ে যান। যদিও তন্ত্রোক্ত কর্মে অধিকার প্রত্যক্ষ গুরুনির্দেশ ভিন্ন করা আজও নিষিদ্ধ সাধারণের জন্য।
কলাবতী দীক্ষা যোগদীক্ষা। ষটত্রিংশদ কলা হতে উৎপন্ন মাতৃকাক্ষর সম্ভূত বিবিধ মন্ত্রজালকে নিজের শরীর থেকে যোগবলে শিষ্য শরীরে সঞ্চারিত করে সর্বমন্ত্রের সারভূত কোনো মন্ত্র প্রদান করা হয়। বর্তমানে কোনো গুরুই এই দীক্ষা দানে সমর্থ নন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব এই দীক্ষা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
ক্রিয়াবতী দীক্ষা জটিল। চক্র বিচার করে শিষ্যের সাধ্য মন্ত্র নির্বাচন করে সেই মন্ত্র যথোক্ত বিধানে পূজা-অভিষেকাদি দ্বারা প্রদান করা হয়। এই দীক্ষার বহু অঙ্গোপাঙ্গ দীক্ষা আছে। যেমন মন্ত্রাভিষেক বা শাক্তাভিষেক, পূর্ণাভিষেক, সাম্রাজ্যাভিষেক ইত্যাদি। উচ্চ উচ্চকোটির সাধক উচ্চ উচ্চতর দীক্ষা লাভ করে। গাণপত্যদের অষ্টবিধ, শাক্তদের দশ থেকে ষোলো প্রকার, শৈবদের পাঁচ প্রকার, বৈষ্ণবদের তিনপ্রকার এইরূপ ক্রিয়াদীক্ষার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই দীক্ষা শিষ্যকে ব্রাহ্মণের থেকেও উচ্চতর মর্যাদা প্রদান করে থাকে তাই এই দীক্ষার নামে বর্তমানে বহু ভণ্ড গুরু বাজার খুলে বসে আছে যার ফলে দুর্লভ থেকে দুর্লভতর এই দীক্ষাগুলি মানুষ নিছক স্নান মনে করে গ্রহণ করে চলেছে।
এছাড়াও বাচিক দীক্ষায় গুরু শিষ্যের জিহ্বায় মন্ত্র লিখে দেন, লেখ্য দীক্ষায় গুরু শিষ্যকে মন্ত্রাদি লিখে প্রদান করেন ইত্যাদি বহুতর দীক্ষা শাস্ত্রে বর্ণিত।
তবে দীক্ষাদাতা গুরু পাওয়া জটিল কর্ম। খ্রীষ্টানরা স্থানীয় চার্চের যেকোনো অধিকারপ্রাপ্ত ব্যাপ্টিসমদাতা পাদ্রীকেই গুরু মনে করে শ্রদ্ধা করে থাকেন। মুসলমানদের যখন যিনি ঈমাম আসেন তখন তিনিই গুরু। ব্যক্তিগত গুরু যে নেই তা না, যারা ঐসব ধর্মে সাধন মার্গে হাঁটতে চায় তারা ব্যক্তিগত গুরু লাভ করে থাকে। তবে সেটি হিন্দুদের মতো জটিল কর্ম না। ব্যাবসাও এই ধর্মগুলিতে কম গুরুগিরির নামে। হিন্দুদের এই ক্ষেত্রে নাম খুবই খারাপ।
ব্যাপক পরিমাণ হিন্দু ধার্মিক মানুষ অদীক্ষিত। কেউ দারিদ্র দূর করতে সাধনা করতে চায়, কেউ দুঃখ, তো কেউ রো্গ, তো কেউ ভগবানকে পেতেই সাধনা করতে চায়। কিন্তু মনের মতো গুরু পাওয়া এই ক্ষেত্রে খুবই কষ্টকর। শিখ ধর্মে হয়তো এই জন্যেই গ্রন্থ সাহিবকে গুরু জ্ঞান করতে বলা হয়েছে, কারণ গুরু গোবিন্দ সিংজী জানতেন তাঁর পর যথার্থ সাধক কি গুরু শিখ ধর্মে আর কেউ আসবে না। তাই সব গুরুগিরির অবসান এক শাস্ত্রকেই গুরু বানিয়ে করে গেছেন।
কিন্তু হিন্দুদের সেকাজ সম্ভব না। হিন্দুদের শাস্ত্র তো কম না! আর দেবতাও কম না। আবার দেবতা ভিত্তিক শাস্ত্রও বহুতর। ফলে একীকরণ অসম্ভব।
এসবের জন্যই মঠমিশনের দীক্ষার গুরুত্ত্ব আরো বেড়ে যায়।কারণ এক্ষেত্রে একজন সদ্গুরুকে সামনে রেখে (যেমন কৈবল্যধামে শ্রীশ্রী রামঠাকুরকে, রামকৃষ্ণ মিশনে পরমহংস রামকৃষ্ণদেবকে, সৎসঙ্গে শ্রীঅনুকুলচন্দ্রকে, ভারতসেবাশ্রমে শ্রীপ্রণবানন্দ মহারাজকে ইত্যাদি), নামমন্ত্র বা বীজমন্ত্র উপদেশ করা হয়। এক্ষেত্রে গুরু বাছাই, কি যাচাই কোনোটাই করার ঝামেলা থাকে না কিন্তু সাধনার সম্পূর্ণ সহজ রাস্তা মানুষ পেয়ে যায়।
কিন্তু, মানুষের লোভ যে বড্ড বড়! সাধারণ উপদেশ দীক্ষায় নিজের মতো পুজো আচ্ছার অধিকার মানুষ পায়, শাস্ত্রের জোড়ালো বিধিবিধান পালন করতে লাগে না-অবৈধি ভক্তি। কিন্তু, এতে তান্ত্রিক পুজো আচ্ছার অধিকার মেলে না, যজমানির অধিকার মেলে না, নিজে গুরু হওয়ার অধিকার মেলে না; ফলে তান্ত্রিক ক্রিয়াবতী দীক্ষার প্রতি সাধারণ মানুষের ঝোঁক বেশি থাকে।
এখানে আবার সমস্যা হলো, লোভের বা অত্যাগ্রহের বশবর্তী হয়ে যারা দীক্ষা নিতে যায়, তারা নিজেদের ধার্মিক, ভক্ত, ও সদশিষ্য বলেই মনে করে গুরুকরণ করতে যায়। কিন্তু গুরু যদি সদ্গুরু হন, তবে তিনি সবার আগে এই অহংকারটাই শিষ্যের কাটান, নিজের দুর্ব্যবহার দিয়ে। আমি এমনও শুনেছি, উচ্চতর দীক্ষালোভে আসা শিষ্যদের কোনো এক পরম্পরার গুরু বলতেনঃ “এই বাড়ি থেকে এক বছর পায়খানা পরিষ্কার করবি, তবে গিয়ে দীক্ষা পাবি!”
যে সকল শিষ্য ফিরে গেছেন, তারা সেই গুরু নিন্দায় পঞ্চমুখ, “ওর শিষ্য নয় জমাদার চাই!”, “আমি কি বাড়ির চাকর নাকি যে এইসব নোঙরা ঘাটব!”…
আর যারা সেই জনৈক গুরুর বাড়ি থেকে একবছর পায়খানা কেন, বাড়ির চাকরের বৃত্তিই করেছেন, তারা সকলেই আজ সিদ্ধপুরুষ। সেই শিষ্যদেরই জনৈক আমাকে বলেছিলোঃ “গুরু ঘরের চাকর না হলে, মায়ের ঘরে চাকরি করব কেমনে? মা তো মূলাধারে, গুরু সহস্রারে!”
এহেন বিনম্রতা খুব কম শিষ্যের দেখেছি। অমুক গুরু মহাশাক্ত, মেধাসাম্রাজ্য দেবে, অমুক গুরু সব আম্নায় জানে, পূর্ণাভিষেক দেবে! আমার গুরু বলতেনঃ “হেগে ছুঁচোতে পারে না আর সুধাসাগরে ডুব দেবে, তারপর সেখানে মুতে দিলে কি মা পরিষ্কার করবে?”
সাধন জগৎ বড়ই দুর্বিষহ, অনেক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।গুরুদত্ত মন্ত্র লাভ করে শিষ্যের অভি্যোগঃ “আমার সব ঐ গুরু ধ্বংস করেছে, এমন মন্ত্র দিলো আমার সব ছাড়কাড় হয়ে গেলো!”
আমি সেই শিষ্যের গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ “কি দীক্ষা দিয়েছিলেন যে এই হলো?”
তিনি বলেছিলেনঃ “কালীই তো দিলুম।এখন শ্মশ্মানবাসিনীকে ডাকবে তো ঘর কি সোনায় ভরে যাবে? মুক্তি আর ভোগ কি একসাথে হয়? মা একটু পরীক্ষা করবে না?”
সাধনার প্রথম ধাপ এই পরীক্ষা, আগে গুরু করেনঃ অস্রাব্য ভাষায় অপমান, ইচ্ছার বিরূদ্ধ কাজ করতে দেওয়া, এমন মন্ত্রোপদেশ করা যা নিতে শিষ্যের মন চায় না। শিষ্য সব সইলে তবে গুরু উচ্চ দীক্ষা দেন। এবার উচ্চ দীক্ষা ঠিক হয়েছে কিভাবে বুঝব? একঝটকায় প্রথমে একের পর এক বিপদ, দুর্যোগ আসতে থাকবে। গুরু বলেনঃ “এ জীবনে ভোগ না করলে, পরের জীবনে ভোগ করতে আবার জন্মাবে। তাই এ জীবনেই সব হয়ে গেলে ভালো…”।
মেধাসাম্রাজ্য মানে যে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া তাতো নয়, নিজে জগদ্গুরুর আসনে বসাও নয়। এ হলো সংসারকে শ্মশ্মান করে শ্মশ্মানবাসিনীর সাধনা! যে বুকে সেই সৎসাহস নেই, সব হারিয়েও গুরুর পা ধরে থাকার ধৈর্য্য নেই, সেকি আদৌ উচ্চতর দীক্ষার অধিকারী?
এক গুরুর কাছে এক শিষ্য এলো দারিদ্র দূর করার মন্ত্র নিতে। গুরু বললেন, “প্রতি গুরুবার উপোস করে লক্ষ্মীপুজো করবা আর পাঁচালী পড়বা। মা সব কষ্ট দূর কইরা দিবো।”
সেই শিষ্যের পোশায় নি। সে কোন এক মহাশাক্ত গুরু থেকে কমলা মহাবিদ্যা নিলো, পরে শুনি সে এখন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করে, বাড়িতে দারিদ্র সামান্য কমেছে কিন্তু উন্নতি কিছু হয় নি।সেই পূর্বের গুরু বলেছিলেনঃ “বেস্পতি বারের লক্ষ্মীব্রত যে করে না, তার ঘরে লক্ষ্মী টেকে না। রাজরাজেশ্বরীও কিসু দিতে পারবা না, যার মনে বারদেবতায় ভক্তি নাই…”।
আর সত্যিই তো। কত লোক শুধু মন্ত্র চাই মন্ত্র চাই করে। চণ্ডী পাঠ করব, চণ্ডীমঙ্গল পড়তে লজ্জা। মহাষোড়শী করব, কিন্তু লক্ষ্মীর পাঁচালীতে অশ্রদ্ধা। কালী পুজো করব, কিন্তু শীতলায় ভক্তি নেই, ছিন্নমস্তা চাই কিন্তু মনসা ছোটলোকের দেবী!
আমার গুরুদেবকে আমি গণেশ মন্ত্র চাই বললে আমাকে গনেশের অষ্টোত্তর শতনাম দিয়ে বলেছিলেনঃ নিত্য পাঠ করবে, এতেই যা হওয়ার হবে।
আমি করেওছি তাই একবছর, পরের বছর গুরুদেব সাঙ্গোপাঙ্গো মহাব্রহ্মণস্পতি অভিষেক দিয়েছিলেন। বলেছিলেনঃ “নাম পাঠে চিত্তশুদ্ধি হয়, এতে মন্ত্র ফল দেয় আগে।” আজও বিশেষ পর্বে সেই অষ্টোত্তর শতনাম পড়ি।
আমার এক গুরুভাই একই ভাবে শ্রীবিদ্যা চাইলে বলেছিলেনঃ “সকালে উঠে প্রতিদিন কাগজে একশো আটবার দুর্গা লিখবে। ওতেই হবে।”
সে তাই করেছে প্রায় তিন বছর। চতুর্থ বছরে সে উত্তরাম্নায় পঞ্চদশী ক্রম লাভ করে।সে আজও সকালে দুর্গা নাম ১০৮ লিখে যেকোনো কাজে বেড়োয়। সে নিজেই আমাকে বলেছেঃ “যেদিন লিখিনি সেদিন সারাদিন বাজে গেছে, যেদিন যেদিন লিখি, সেদিন কিছু না কিছু লাভ হয়।”
এই ক্ষুদ্রভক্তি, এই সামান্য বিশ্বাসগুলি, বড় বড় অভিষেককে হার মানায়। সাধারণ অদীক্ষিতদের জন্য অজস্র মঙ্গলকাব্য, পাঁচালী, ব্রত, নামগান আছে, সেইগুলিতে কারো ভক্তি দেখি না। পূর্ণাভিষেক না হলে আজ দীক্ষাই যেন বৃথা! অথচ পুর্ণাভিষেক পেয়ে আমার আজও লজ্জা হয় এই ভেবে যে বিষয়বাসনা আমার মনে আজও মারাত্বক! কি করলাম দীক্ষা নিয়ে?
সদ্গুরু শাসন করলে শিষ্যের গায়ে লাগে আজকাল। আগে শুনতাম গুরুরা বেত মারত শিষ্যদের, যদি সামান্য চরিত্রহানি হয়! আজ চরিত্রহীন শিষ্যরা গুরুদের চরিত্র বিচার করে! অমুক পরম্পরা, অমুক ক্রম, অমুক দর্শন…আজকাল আবার প্রত্যভিজ্ঞা, অদ্বৈতবাদ, ত্রিক দর্শন এসব নিয়েও খুব চর্চা হয়। যারা বেদান্ত বা ত্রিক সিদ্ধান্তে রিসার্চ করছে, তাদেরকেও ভুল বলে আজকালকার শিষ্য মণ্ডলী!
গুরু দু’পয়সা ধার চাইলে শিষ্য সুদ সমেত ফেরত নেয়! গুরুর দারিদ্র মেটাবার ক্ষমতা নেই, রাজরাজেশ্বরী মন্ত্র চাই!
শুনতে খারাপ লাগলেও একথা ধ্রুব সত্য, আমরা কেউ সাধক নই! উচ্চতর দীক্ষার কী, সামান্য মন্ত্র জপের অধিকার টুকুও আমাদের নেই-মন এতো ময়লায় ভর্তি! গুরুকে শিষ্য সাজেস্ট করতে পারে না কি মন্ত্র চাই-আমি গাণপত্য চাই, আমি শাক্ত চাই, আমি শৈব চাই…গুরু শিষ্যকে যা দেবে তাই নিতে হবে মাথা পেতে! যে তা নিতে পারে সেই শিষ্য, আর তা না হলে জটিল তান্ত্রিক দীক্ষায় না গিয়ে সাধারণ মঠমিশন থেকে নামদীক্ষা নিলেই সবচেয়ে ভালো। আমি আজ অবধি মঠমিশনের আশ্রিতদের দৈন্যতা দেখিনি, দেখেছি বড় বড় তন্ত্রমার্গীদের সর্বস্বান্ত হতে!
এই জন্যে প্রভু যীশুর কথাটি আমার সবচেয়ে প্রিয়ঃ “প্রার্থনা করো, যেন প্রলোভনে না পড়ো! আত্মা ইচ্ছুক (মুক্তির জন্য) বটে, কিন্তু রক্তমাংসের এই শরীর বড়ো দুর্বল!”