29/05/2021
’বিরিয়ান’ আর ‘বিরিঞ্জ’ ফারসি শব্দ। ‘বিরিয়ান’ শব্দের অর্থ ” রান্নার আগে ভেজে নেয়া” আর “বিরিঞ্জ” অর্থ হচ্ছে “চাল”। রান্নার আগে ঘি দিয়ে ভেজে নেয়া হয় সুগন্ধি চাল, আর সে কারণেই বিরিয়ানির এমন নামকরণ।
এশিয়ার পশ্চিমাংশ থেকেই মূলত বিরিয়ানির উৎপত্তি। তবে বিরিয়ানির উৎপত্তির হাজারো গল্পের মাঝে তিনটি গল্পই সবচেয়ে বেশি ঐতিহ্যবাহী ও প্রচলিত।
> প্রথম গল্পটি হল তুর্কি মঙ্গল বিজয়ী তৈমুরের। তিনিই নাকি ১৩৯৮ সালে বিরিয়ানিকে ভারতবর্ষের সীমানায় নিয়ে আসেন। সেসময়ে একটা বিশাল মাটির হাঁড়িতে চাল, মসলা মাখা মাংস ও ঘি একসঙ্গে দিয়ে ঢাকনাটা ভালোভাবে লাগিয়ে দেয়া হতো। এরপর গনগনে গরম গর্তে হাঁড়িটি মাটি চাপা দিয়ে রাখা হতো সবকিছু সেদ্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। এরপর হাঁড়িটি বের করে তৈমুরের সেনাবাহিনীকে খাওয়ানো হতো। সেটিই এখন বিশ্বজুড়ে বিরিয়ানি নামে পরিচিত।
> দ্বিতীয়টি হলো আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে ভারতবর্ষে বিরিয়ানি আসার গল্প। ভারতবর্ষে বিশেষ করে মালাবারের দক্ষিণ উপকূলে তুরস্ক ও আরব ব্যবসায়ীদের বেশ আনাগোনা ছিল। তাদের কাছ থেকেই নাকি বিরিয়ানির উৎপত্তি হয়েছে। তবে পুস্তকে এই ঘটনার ব্যাখ্যা তেমন একটা পাওয়া যায়নি।
> তৃতীয় তবে এসব গল্পের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত ও সমাদৃত হল মুঘল সম্রাজ্ঞী মমতাজ এর গল্পটি। ইতিহাস বলে ভারতবর্ষে বিরিয়ানির সূচনাটা নাকি তিনিই করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে, একদিন সম্রাজ্ঞী মমতাজ সৈন্যদের ব্যারাকে যান তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। তবে সেখানে গিয়ে দেখেন, সৈন্যদের খুবই করুণ অবস্থা। তাদের ভগ্ন স্বাস্থ্য তাকে এতই ভাবিয়ে তুললো যে তিনি তৎক্ষনাৎ সৈন্যদের বাবুর্চি কে ডেকে আনলেন। আর নির্দেশ দিলেন চাল ও মাংস দিয়ে এমন একটা খাবার তৈরি করতে যা সৈন্যদের পুষ্টি দেবে ও স্বাস্থ্যও ফিরিয়ে আনবে। আর তারপর যে খাবার টা তৈরি করা হলো, সেটাই আজকের বিরিয়ানি নামে পরিচিত। দারুন স্বাদের এই বিরিয়ানি এরপর খুব সহজেই চলে এলো মুঘলদের খাবারের পাতে। আর মুঘলরা ভারতের যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই বিরিয়ানি কে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
বিরিয়ানি মূলত ২ ধরণের হয়। ’কাচ্চি’ আর ’পাক্কি’। ’কাচ্চি বিরিয়ানি’তে সবকিছু একসাথে (মশলা, টকদই মাখানো কাঁচা মাংস, কাঁচা আলু, চাল, ঘি, ড্রাই ফ্রুটস) হাড়িতে দিয়ে হাড়ির মুখ চেপে বন্ধ করে সময় নিয়ে দমে দিয়ে রান্না করা হয়। আর ’পাক্কি বিরিয়ানি’তে মাংস আলাদা রান্না করে, চাল ভেজে নিয়ে পরে স্তরে স্তরে সাজিয়ে দমে রাখা হয়।
যুগে যুগে রান্নার প্রক্রিয়া ঠিক রেখে বিরিয়ানিতে এসেছে নানা পরিবর্তন, স্থানভেদে এসেছে স্বাদের ভিন্নতা যার প্রত্যেকটির আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন -
> ’লখনউ বিরিয়ানি’ (পূর্বে আওদ) সবথেকে আসল রেসিপি ব্যবহার করে। 'দম পুখত' পদ্ধতি ব্যবহার করে রান্না করা হয় যেটা দম বিরিয়ানি নামে বেশি পরিচিত। 'দম পুখত' মূলত ফারসি শব্দ যার অর্থ 'স্লো ওভেন'। এটা রান্নার সবথেকে পরিশোধিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতি গত ২০০ বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তান ব্যবহার করে আসছে।
> 'কলকাতা বিরিয়ানি' ইতিহাসের জন্য যেতে হবে ১৫০ বছর পিছনে। সিপাহী বিদ্রোহের আগে ৬ মে ১৮৫৬ সালে লখনউ এর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ কলকাতা এসে পৌছালেন। ব্রিটিশ রাজ তার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। তার উদ্দেশ্য কলকাতা হয়ে লন্ডন গিয়ে রাণির কাছে আবেদন করবেন। কিন্তুু বিধিবাম শারীরিক অসুস্থতার কারণে তা আর হয়ে উঠল না। তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতার মেটিয়াবুরুজের ১১ নাম্বার বাংলোতে, ৫০০ টাকার বিনিময়ে। যা কিনা বর্ধমান রাজার সম্পত্তি ছিল। কলকাতায় স্থায়ী হয়েই তিনি নানা নবাবী কায়দা চালু করেন। কিন্তুু কলকাতার রাঁধুনিদের খাবার তিনি পছন্দ করতেন না। তাই লখনউ থেকে নিয়ে আসলেন তার খাস বার্বুচিদের। আর তাদের রান্নার জাদুতেই কলকাতা শহর প্রথম বিরিয়ানির গন্ধ পেল। লখনউ বিরিয়ানি আর কলকাতা বিরিয়ানি মধ্যে কিছুটা পার্থক্য পাওয়া যায়। যার একটি হল কলকাতা বিরিয়ানিতে অনেক কম মশলা ব্যবহার করা হয়। তার কারনটাও নাকি নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ নিজেই। তিনিই নাকি বার্বুচিকে কম মশলায় বিরিয়ানি তৈরি করতে বলেছিলেন। আর নবাব সাহেবের আদেশ বার্বুচির অমান্য করার ক্ষমতা হয়নি। তা থেকেই কলকাতা বিরিয়ানিতে কম মশলা ব্যবহারের ব্যাপার টা রয়ে গেছে। আর দ্বিতীয়টি এবং সবথেকে ভিন্ন জিনিস টি হল কলকাতা বিরিয়ানির আলু। ভারতবর্ষে আলু আনে পর্তুগীজরা। অতএব ইর্ম্পোটেড। সে সময় বিরিয়ানিতে আলু হচ্ছে ডেলিকেসি। অসমর্থিত একটা মত হল গিয়ে নবাবের অর্থ সংকটের কারনে এবং মাংসের দাম বৃদ্ধির জন্য তৎকালে বিরিয়ানিতে আলু যোগ হয়। তবে সে যাই হোক এই সময়ে পাতে আলু না আসলে বিরিয়ানি প্রেমিদের মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারে।
> 'হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি' তৈরি হয় নিজাম উল মুলক এর হাত ধরে। আওরঙ্গজেব হায়দ্রাবাদ আক্রমণ করে দেশটির শাসন ভার নিজ হাতে তুলে নেন। এরপর তিনি নিজাম উল মুলককে হায়দ্রাবাদের দায়িত্ব দেন। তিনি ছিলেন ভোজন রসিক। নিজামের নির্দেশে প্রায় ৪৯ ধরনের বিরিয়ানি তৈরি হয়েছিল। মাংস ছাড়াও মাছ, কোয়েল, চিংড়ি, হরিণের মাংস, খরগোশের মাংস দিয়ে বিরিয়ানি হত।
> 'দিন্দিগুল বিরিয়ানি' চেন্নাই এর বিরিয়ানি। বড় টুকরার পরিবর্তে এতে ছোট ছোট করে মাংস টুকরা দেওয়া হয়। জিরা সাম্বা রাইস ব্যবহার করা হয়। দই আর লেবুর রসের কারণে একটু টক স্বাদের হয়।
> 'আম্বুর বিরিয়ানি' আরকোটের নবাবের আমলে তামিলনাড়ুর ভেলোরে স্থানীয় মুসলিমরা প্রথম তৈরি করে। ভেলোরের আম্বুর ও ভানিয়ামবাড়ির আশেপাশের এলাকাগুলোতে এই বিরিয়ানি বানানো হয়। সাধারণত মুরগি দিয়ে তৈরি হয়। সাথে বেগুনের কারি ও রায়তা দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
> 'থালেশ্বরী বিরিয়ানি' কেরালার মালাবরের মুসলিমদের উদ্ভাবিত খাবার গুলোর একটি। এই বিরিয়ানিতে খায়মা চাল ব্যবহার করা হয় সঙ্গে থাকে প্রচুর ঘি, কাজুবাদাম সুলতানা কিসমিস। এই বিরিয়ানিতে মাংসের সাথে চিংড়ি মাছে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
> 'কল্যাণী বিরিয়ানি' বিদারের কল্যাণী নবাবদের হাত ধরে হায়দ্রাবাদে আসে। কল্যাণী নবাবরা হায়দ্রাবাদে আসার পর তাদের পরিবারের গাজানফার জাং এর সাথে আসাফ জাহীর পরিবারে বিয়ে দেয়া হয়। বিদার থেকে যারা হায়দ্রাবাদে আসতো তাদেরকে নবাবের পক্ষ থেকে কল্যাণী বিরিয়ানি পরিবেশন করা হতো। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ‘অপারেশন পোলো’ পরিচালনার পর কল্যাণী নবাবের পরিবার পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় প্রাসাদের বাবুর্চিরা হায়দ্রাবাদে দোকান খুলে কল্যাণী বিরিয়ানি বিক্রি শুরু করে। সাধারণত এই বিরিয়ানিতে ভেড়ার মাংস ব্যবহৃত হয়।
> 'মেমোনি বিরিয়ানি' পশ্চিম ভারতের গুজরাট-সিন্ধু এলাকার মেমোনিদের আবিষ্কার। ভেড়ার মাংস, দই, ভাজা পেঁয়াজ ও আলুর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় মেমোনি বিরিয়ানি।
> 'বোহরি বিরিয়ানি' এর বিশেষত্ব হলো টমেটোর আধিক্য। পাকিস্তানের করাচিতে খুব জনপ্রিয়।
> 'সিন্ধি বিরিয়ানি' পাকিস্তানের সিন্ধুতে এই বিরিয়ানি পাওয়া যায়। মাংস, বাসমতী চাল, সবজি ও হরেক রকম মশলার সংমিশ্রণে প্রস্তুত হয় সিন্ধি বিরিয়ানি।
> 'লাহোরি বিরিয়ানি' উদ্ভব পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে। মাত্রাতিরিক্ত মশলা ও ঝোল এই বিরিয়ানিকে আলাদা বিশেষত্ব প্রদান করেছে।
> 'আফগান বিরিয়ানি' হচ্ছে পোলাও আর বিরিয়ানির সমন্বিত খাদ্য। চাল ও মাংস একসাথে রান্না করে বিরিয়ানি প্রস্তুত করে সাথে শুকনো ফল ও প্রচুর পরিমাণ মাংস কেটে ছোট ছোট করে ছড়িয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে এই বিরিয়ানি আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপালে পাওয়া যায়।
> 'পেশোয়ারী বিরিয়ানি' তে কোন মাংস ব্যবহার হয় না। মাংসের পরিবর্তে এতে থাকে মটরশুটি, কাবুলি চানা, ছোলা, বিভিন্ন ধরনের বাদাম ও জাফরান।
> এছাড়াও 'রাজস্থানি বিরিয়ানি' যেটা আজমির শরীফে গরীবে নেওয়াজের দরগায় তৈরি হয় তার প্রশংসাও মুখে মুখে। আরও আছে 'দারিয়াবাদি বিরিয়ানি' এটা কাচ্চি বিরিয়ানির একটা ধরন। প্রচুর ড্রাই ফুটস থাকে।
> এবার যাওয়া যাক ১৯৩৯ সালে। হাজী আহমেদ আলি সাহেবের হাত ধরে চলা শুরু হল পুরান ঢাকার নারিন্দার মনির হোসেন লেনে প্রথম বিরিয়ানির দোকান। তবে আগের ঠিকানায় আর নেই প্রতিষ্ঠানটি, বর্তমান ঠিকানা হল আলাউদ্দিন রোড নাজিরা বাজার। যা আজকে 'হাজির বিরিয়ানি' নামে পরিচিত। হাজির বিরিয়ানি থেকেই ঢাকায় শুরু হয় বিরিয়ানি শিল্প। তারপর আসে।বেচারাম দেউরির হাজি নান্না মিয়ার বিরিয়ানি, ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি, নারিন্দার ঝুনুর বিরিয়ানি, জেনেভা ক্যাম্পের বোবার বিরিয়ানি। ঢাকাই বিরিয়ানি দোকান গুলো প্রথম দিকে পুরান ঢাকার দিকে হলেও তা আর থেমে থাকেনি বরং নতুন ঢাকার গন্ডি পেরিয়ে সুদূর প্রবাসে চলে গেছে এর জৌলুস
ইতিহাস জানা হয়ে গেল এখন বিরিয়ানি খাবার পালা। তাই জলদি কল (০১৯১৭৮৮০৪৬৬)/ইনবক্স করুন।
চিকেন বিরিয়ানি
প্রতি বক্স - ১২০/-