12/08/2015
মাহতাব সাহেব ঝাড়া আধঘণ্টা যাবত ওয়েটিং রুমে
বসে আছেন । তার ডাঃ এনায়েত হোসেনের
সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে । ডাঃ এনায়েত
ঢাকা শহরের বেশ নামিদামী একজন মনোরোগ
বিশেষজ্ঞ । প্রায় ছয়মাস আগে থেকেই ডাঃ
এনায়েতের সঙ্গে মাহতাব সাহেবের পরিচয় ।
তখন মাহতাব সাহেব ছিলেন একজন পেশেন্ট ।
সেই থেকেই পরিচয় । আজ আবার ছয়মাস পর
তাকে আবার সেই ডাঃ এনায়েতের শরণাপন্ন হতে
হয়েছে । তবে আজকের ব্যাপারটা বেশ একটু
ভিন্ন । আজ তিনি আবার মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি
হতে এসেছেন । কেউ জোর করে নিয়ে
আসেনি তিনি একা একাই চলে এসেছেন । আমি
প্রায় ফুট দুয়েক দূরেই দাড়িয়ে আছি ।
ডাঃ সাহেব আসতে এখনো বেশ কিছু সময় বাকি ।
এই ফাঁকে আমার পরিচয় পর্বটা সেরে ফেলি ।
আমার নাম মোঃ ইউনুস আলি । আমি এই হাসপাতালে
প্রায় বছর চারেক যাবত কম্পাউন্ডারের কাজ করছি ।
কাজ বলতে আমাকে তেমন কিছু করতে হয়না ।
এই শুধু সিরিয়াল ডাকা আর মাঝে সাঝে মুখখিস্তি
করতে করতে কিছু পাগলা কে ঠ্যাঙ্গানো ।
প্রথম প্রথম আমার এই কাজ করতে একটু ভয় ভয়ই
লাগতো । পরে দেখলাম কাজটা বেশ মজার ।
বিশেষ করে ঐ ঠ্যাঙ্গানোর কাজটা । তাও কাজ
প্রায় নেই । কিন্তু তাতে কি ডিউটি করতে হয়
রোজ ১২ ঘণ্টা করে । প্রথম দিকে ভীষণ
বিরক্ত লাগতো, মাঝে মধ্যে ভাবতাম এই বালের
চাকরি ছেড়ে দেই কিন্তু কি আর করার বুড়ো বাপ
পড়ে আছে বিছানায় , একজন এস,এস,সি পাশ
স্টুডেন্ট কি আর চাকরি ছাড়লে চলে । তাই নেহাতি
পড়ে আছি কম্পাউন্ডারের সিটটা কামড়ে । পড়ের
দিকে সময় কাটানোর জন্যে একটা ডায়েরি কিনে
ফেললাম । যখন কাজ থাকতোনা তখন তখন বসে
বসে ডায়েরি লিখতাম । তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু
যে লিখতাম তা না । শুধু লিখতাম ।
আমার সাথে মাহতাব সাহেবের দেখা হলও ঐ
ছয়মাস আগেই । আমি আমার চার বছরের চাকরী
জীবনে তার মতো কোনও রোগী দেখিনি
। উনি যেদিন হসপিটালে এলেন সেদিন আমি প্রায়
ভুত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম । তার
মতো একজন স্বনামধন্য লেখকও যে মানসিক
রোগী হতে পারে একথা আমার ধারনাতেও
ছিলোনা । তাকে দেখে মনেও হচ্ছিলোনা
যে উনি পাগল । বেশ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই
হাঁটাচলা করছিলেন । আমাকে দেখেই বলে
উঠলেন - বাবা এখানে চা সিগারেট পাওয়া যায়তো ,
আমার আবার ওদুটো ছাড়া একদম চলেনা । কে
জানে কদ্দিন এখানে থাকতে হবে ? ওনার
রোগটাও ছিল আশ্চর্যজনক । উনি মাঝে মধ্যে
উনার গল্পের চরিত্রদের মতো আচরণ করা শুরু
করতেন । এই ছিল ওনার রোগ । সেবারে
সেরে উঠতে ওনার সময় লাগে মাসখানিক মতো
। এই এক মাসে ওনার যাবতীয় চা সিগারেটের
ব্যাবস্থা যে আমাকেই করতে হতো তা তো
বলাই বাহুল্য । আজ প্রায় ৫ মাস বাদে দেখছি
ওনাকে । আমার দেখা পেতেই বলে উঠলেন
কি হে ইউনুস আবার যে আমার চা সিগারেটের ভার
পড়লো হে তোমার উপরে – বলেই হা হা
করে হেসে উঠলেন । আমি আমার চার বছরের
চাকরী জীবনে দ্বিতীয় বারের মতো ভুত
চমকানো চমকালাম । এই ভুত চমকানো শব্দটা
আমারই আবিষ্কার তাও আবার শুধু এই ভদ্রলকের
জন্যেই করতে হয়েছে ।
ডাঃ স্যারও প্রথমে বেশ একটু ঘাবড়ে গেলেন ।
সুস্থ হয়ে চলে যাওয়া কোনও পেসেন্ট আবার
ফেরত এসেছে এ নজির বোধহয় তারও ডাক্তারি
জীবনে এই প্রথম দেখা । তবে একজন
এক্সপেরিয়েন্সড ডাক্তারের মতই ঠিক
পরোক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলেন ,
একগাল হেসে বলে উঠলেন – কি ব্যাপার
লেখক সাহেব হটাৎ চরণধূলি দেবার কারন কি ?
- এখানেই বলতে হবে নাকি আপনার কন্সালটিং
রুমে বসার সুযোগটা মিলতে পারে ?
- সিউর সিউর চলুন ভেতরে বসা যাক । এবার স্যার
আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন – কেউ
যেন ডিস্টার্ব না করে খেয়াল রেখো ।
আমিও বাধ্য ছেলের মতো ঘার কাত করে দরজা
খুলে দিলাম । স্যারের রুমটা এসি রুম । দরজা জানালা
যেখানেই কান পাতা হোক না কেন এক বর্ণও
শোনা যাবে না । কাজেই গল্পের বাকি অংশ
লিখতে হচ্ছে আমার ফোনের রেকর্ডিং
থেকে । আমার ফোন বলাটা অবশ্য একটু ভুলি
হলও । ফোনটা হাসপাতাল থেকে দেয়া ।
অন ডিউটি কর্মকর্তাদের সবার কাছেই থাকে ।
মাহতাব সাহেবের প্রতি আলাদা কৌতূহল থাকায় আগে
থেকেই স্যারের রুমে ফোনটা সেট করে
এসেছিলাম । যাহোক , এবার রেকর্ডের ধারাবর্ণনা
দেয়া যাক ।
ভেতরে ঢুকেই তারা চেয়ার টেনে বসে
পড়লেন ।
- তারপর মাহতাব সাহেব এবারে বলুন কি মনে করে
এখানে আসা ।
- বলছি ডাক্তার সাহেব বলছি । আগে একটা সিগারেট
ধরানো যাক । আপনার সিগারেট চলে তো ?
- তা চলে তবে আপনার সামনে খেতে চাইছি না ।
- আপনাদের এই এক ভ্যাজাল ডাক্তার মশাই ,
অন্যদেরকে উপদেশ দিতে হয় বলে শান্তিমত
সিগারেটটাও খেতে পারেননা । বাসায় লুকিয়ে
লুকিয়ে খেতে হয় । আবার পত্নিদেবের তাতে
সমস্যা থাকলে তো আরও বিপদ । হা হা হা , ঠিক
বলেছি কিনা বলুন ।
- তা যে একরকম ঠিকই বলেছেন তা মানছি । তবে
এপ্রন না থাকলে লোকে আপনার আর আমার
মাঝে ফারাক কি বুঝবে?
- তাও সত্য । যাকগে আপনি না খেলে না খাবেন ।
আমি খাই। এবারে ঘটনায় আসা যাক। প্রথমেই বলে
রাখি আমি কিন্তু এখন আর পাগল নই । কাজেই পাগল
ভেবে আমার কথা শুনবেন না । পাগলের কথা
কেউ মনোযোগ দিয়ে শোনে না । আমি
আসলে আপনার অ্যাসাইলামে আবার ভর্তি হতে
এসেছি ।
- আপনি এই মাত্র বললেন যে আপনি পাগল না অথচ
আপনি অ্যাসাইলামে ভর্তি হবেন? কারণটা কি জানতে
পারি ।
- কারণটা বলতেই তো এসেছি ডক্টর । শুনুন ,পাঁচ
মাস আগে আমি যখন এখান বেরুলাম তখন
দেখলাম আমার পাগলা হওয়ার ব্যাপারটা মোটামুটি
রাষ্ট্র হয়ে গেছে । মিডিয়া যেন আমার পাগল
হওয়ার অপেক্ষাতেই বসে ছিল । আমি অবশ্য
ব্যাপারটা তেমন গায়ে মাখলাম না । একমাস আগের
খবর কেই বা মনে রাখবে । ব্যাপারটা গায়ে
মাখতামও না যদি না ধীরে ধীরে অসঙ্গতি
গুলো আমার কাছে ধরা পড়তো । প্রথম
অসঙ্গতিটা লক্ষ্য করলাম আমার ছেলে ও
ছেলের বউএর মাঝে । তারা প্রায় সব সময়েই
আমার ভয়ে তটসথ হয়ে থাকতো । ছেলেকে
কখনও কথা বলার জন্য ডাকলে মনে হত তার হাত পা
ভয়ে কাপছে । বউমা ছিল আরও এক কাঠি ওপরে ।
আমার সামনে পরলেই সে তার হাতের থালা বাসন
ফেলে দিতো । এ ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে ।
বউমার সতর্কতার আরেকটা নমুনা ছিল তার ৫ বছরের
ছেলের শাসন । সে তার ছেলেকে কখনই
আমার কাছে ঘেসতে দিতনা । ব্যাপারগুলো যে
কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে তা আপনি নিজে
ফেস না করলে বুঝবেন না । যন্ত্রণাটা এক সময়
বিরক্তিতে পরিনত হল । আমি বাড়ি ছাড়লাম ।ভাবলাম
কোথাও ভাড়া নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে
দেবো । বাড়ি ভাড়া নিলাম গুলশানের দিকে ।
ছোটখাটো সুন্দর একটা ফ্ল্যাট । বাড়িওওয়ালা
ভদ্রলোক ছিলেন একজন ব্যাস্ত ব্যাংকার । প্রথম
মাস বেশ শান্তিতেই কাটালাম। বিপত্তি বাজলো যখন
বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া নিতে এলেন । ভাড়া মেটানোর
পরপরই বলে উঠলেন – শুনলাম আপনি নাকি
লেখক ।
- জ্বি ঠিক শুনেছেন ।
- তা এখন আর লেখালেখি করেন না ?
- জ্বিনা পাগল হওয়ার পর থেকে লেখালেখি বাদ
দিয়েছি ।
- আপনি পাগলও হয়েছিলেন নাকি ?
- জ্বি একমাস পাগল ছিলাম ।
বাড়িওয়ালা ভাবলেন আমি মজা করছি । বললেন – কি
ধরনের পাগল ছিলেন শুনি ।
- আমি আমার গল্পের চরিত্রদের কল্পনা করে
লোকজনকে পেটাতাম । আমার কথা শুনে
বাড়িওয়ালা হো হো করে হেসে উঠলেন ।
আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে চলে গেলেন ।
তার দুদিন পর বাড়ি ছাড়ার নোটিশ এলো । আমাকে
বাড়ি ছাড়তে হল । আমি বাড়ি ফিরে এলাম । আবার
বাড়িতে ভয়ের খেলা চলতে লাগলো । আমার
মনে হল বন্যরা বনে সুন্দর আর অতীত পাগল রা
পাগলাগারদে । কাজেই একটা বুদ্ধি বের করলাম ।
আবার পাগলাগারদে ফেরার বুদ্ধি । একদিন ছেলে
বাড়ি এলে দরজা খুলে তাকে ঠাশ করে একটা চড়
মেরে দিলাম ।চড় দিয়ে গটগট করে রুমে ঢুকে
গেলাম । প্রায় ১৫ মিনিট পর রুম থেকে বেরিয়ে
বললাম বাবা আমার মনে হচ্ছে আমি আবার পাগল
হয়ে যাচ্ছি । তুই আমাকে পাগলা গারদে রেখে
আয় । ব্যাস ছেলে আমাকে পাগলাগারদে আনার
ব্যাবস্থা করে ফেললো ।
এরপর কিছুক্ষণ রূম নিরব থাকলো । হটাৎ করেই
এনায়েত স্যার হো হো করে হেসে
উঠলেন ।
- ভালো গল্প ফেঁদেছেন মাহতাব সাহেব । তা
আপনার ছেলে যদি এসেই থাকে তাকে তো
বাইরে দেখলাম না ।
- বাইরে দেখবেন কি করে ছেলে তো
আসে নাই । এসেছে বউমা । বউমাকে বোরকা
পরিয়ে এনেছি । আপনি বাইরে গেলেই
দেখতে পারবেন ।
স্যার এবারে বেল বাজালেন । আমি ভেতরে
এলাম । স্যার বললেন - ইউনুস বাইরে কি কোনও
বোরকা পরা মহিলা বসে আছেন ?
- জ্বি স্যার আছেন ।
- তাকে পাঁচ মিনিট পর ভেতরে আসতে বলবে ।
- জ্বি স্যার । বলে আমি বাইরে চলে এলাম ।
- এবারে শুধু একটা কথার জবাব দিন । এখানে কি
আপনি শান্তি পাবেন ?
- কি বলছেন ডাঃ সাহেব । এটাই তো আমার জন্য
সবচে শান্তির জায়গা । ভেবে দেখুন ডক , এই
একটা জায়গাতেই আমি পাগল না ছাগল তা নিয়ে কেউ
মাথা ঘামাবে না । যার সাথে ইচ্ছে কথা বলতে
পারবো । কেউ আমাকে দেখে ভয়ে হাতের
থালা বাসন ফেলবে না । মরার আগ পর্যন্ত কেউ
বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেবে না । এর চেয়ে শান্তির
আর কি হতে পারে ?
- আর আমি যদি এন্ট্রি না দেই ?
- তাহলে ওরা আমাকে অন্য কোনও পাগলাগারদে
নিয়ে যাবে । ভুলে যাচ্ছেন কেন ওদের
চোখে আমি পাগল ডক পাগল ।
স্যার এর পড়ে আর কিছু বললেন না । আবার বেল
টিপলেন । আমি বোরকা পড়া মহিলাকে নিয়ে
রুমে ঢুকলাম । স্যার মহিলার উদ্দেশ্যে বললেন
– আপনি ফরমালিটিস পূরণ করুন । ওনাকে ইমিডিয়েট
ভর্তি করাতে হবে ।
মহিলা কথা শুনে এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না । উল্কার
বেগে বেরিয়ে পড়লেন । সাথে সাথেই মাহতাব
সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন ।
- কি বুঝলেন ডক্টর ?
- আপনার অবস্থা খুবি সিরিয়াস । বলে স্যারও হাসতে
লাগলেন । হটাৎ একজন ডক্টর ও লেখকের
মাঝে কি গোপন অভিনয় ঘটে গেলো তা শুধু
তারাই বুঝলেন আর উপরে বসে থাকা
অন্তরীক্ষের একজন রইলো তার সাক্ষী ।
পরিশেষ ঃ বসে বসে সিরিয়াল ডাকছি এমন সময়
ফোনটা বেজে উঠলো । ওপার থেকে
পুরুষালি এক কণ্ঠ বলে উঠলো – আপনি কি ইউনুস
সাহেব বলছেন ? আমি মাসিক পত্রিকা বাঙালি সাহিত্য
সংগ্রহ এর সিলেক্টর মতাব্বের রাহমান বলছি ।
- জ্বি বলুন ।
- আপনার লিখা গল্পটি এবারের মাসিক পত্রের
জন্যে সিলেক্ট করা হয়েছে ।
- ভুল করছেন স্যার গল্পটা আমার লিখা না গল্পটা
মাহতাব সাহেবেরই লিখা । আমি তো স্যার তেমন
পড়ালিখাই করিনাই । ফাইভ পাশ । আমি গল্প কি লেখব ?
আপনাদের যদি গল্পটা পছন্দ হয় তাহলে মাহতাব
স্যারের নামে ছাপতে পারেন ।
#প্রথমা #