01/06/2024
ফার্স্ট লেডি অফ দ্য লেন্স :হোমাই ভিয়ারাওয়ালা
Homai Vyarawalla। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা ফটো জার্নালিস্ট। ২০১৭ সালে তাকে সম্মান জানিয়ে তৈরি করা হয়েছিল গুগল ডুডল আর্ট, আর নাম দেওয়া হয়েছিল "ফার্স্ট লেডি অফ দ্য লেন্স"।
হোমাই ভিয়ারাওয়ালার লেন্সে বন্দি হয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেষের দিনগুলো এবং স্বাধীনতার পরবর্তী কালের ছবি। হোমাই নামের থেকেও তিনি ডালডা ১৩ নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। এই ছদ্মনামের পেছনেও একটি কারণ ছিলো। হোমাই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৩ সালে, মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার সাথে তার প্রেমিকের দেখা হয়, তিনি প্রথম ছবি ১৩ বছর বয়সেই তুলেছিলেন এবং শেষমেষ যেটা হয় সেটি হল তিনি যখন প্রথম গাড়ি কেনেন সেই গাড়ির নম্বর ছিল ডিএলডি -১৩। আর এই ১৩ শব্দ টা যেহেতু তার জীবনে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে সেই কারণে তিনি তার ছদ্মনাম নেন ডালডা ১৩।
১৯১৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর গুজরাটের নাভসারিতে একটি সাধারণ পার্শি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হোমাই ভিয়ারাওয়ালা। তার বাবা দোসসাভাই হাতিরাম ছিলেন উর্দু-পার্শি মঞ্চের একজন অভিনেতা। তিনি ট্রাভেলিং থিয়েটারে কাজ করতেন, আর সেই কারণে প্রায়শই তাদের ঠিকানা বদল হত। হোমাইয়ের মায়ের নাম ছিল সুনাভাই হাতিরাম। বাবার পেশাগত কারণে হোমাই এর শৈশব ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে কেটেছিল। হোমাই এর বাবা মা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না। পরাধীন ভারতের কুসংস্কার এবং অশিক্ষার অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকার সত্বেও এবং ঘরে অভাব অনটন থাকা সত্ত্বেও হোমাই কে কোনদিন কোন কাজ করতে বাধা দেননি তার বাবা মা। পড়াশুনো করতে হোমাই কে সর্বদাই উৎসাহ দিতেন তারা। তারদেও এলাকার গ্রান্ড রোড হাই স্কুল থেকে একমাত্র ছাত্রী হিসাবে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন হোমাই। এরপরে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর 'স্যার জে. জে.স্কুল অফ দ্য আর্ট'এ আলোকচিত্র অর্থাৎ ফটোগ্রাফি বিষয়ে পড়াশোনা করেন হোমাই । ছবি দেখার জন্য যে চোখ দরকার সেই চোখ তৈরি করতে তাকে সাহায্য করেছিল এই আর্ট কলেজ। আর এখান থেকেই তার প্রথম ছবি তোলার প্রস্তাব আসে।তবে তাকে ছবি তোলা শেখান তার প্রেমিক মানেকশো ভিয়ারাওয়ালা, যিনি 'টাইমস ওফ ইন্ডিয়া' তে কর্মরত ছিলেন, মাত্র ১৩ বছর বয়সে মানেকশার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল হোমাই এর পরবর্তীকালে তার সঙ্গেই ১৯৪১ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন হোমাই। হোমাইয়ের শৈল্পিক চোখ তৈরি করতে সাহায্য করেছিল "লাইফ ম্যাগাজিন"ও। একবার পড়ে বেচে দেওয়া ম্যাগাজিনের সংখ্যা গুলো পড়তেন হোমাই, আর সেই ম্যাগাজিনে ছাপা আধুনিকতাবাদী আলোকচিত্র গুলো ছিল হোমাইয়ের প্রেরণা।
প্রথমদিকে হোমাই যে ছবিগুলো তুলতেন সেগুলো তার নিজের নামে ছাপতে তিনি সংকোচ বোধ করতেন, তিনি যেহেতু মেয়ে ছিলেন এবং সকলের অপরিচিত ছিলেন সেই কারণে তার নিজের তোলা ছবি গুলো তিনি তার প্রেমিক মানেকশোর নামে ছাপতেন। নাগরিক জীবন এবং আধুনিক তরুণীদের নিয়ে তোলা তার আলোকচিত্র গুলো সেই সময় 'ইলাস্ট্রেটেড উইকলি' এবং 'বোম্বে ক্রনিকল' এই ম্যাগাজিন দুটোতে বার হত কিন্তু এই আলোকচিত্র গুলো তলায় নাম থাকতো মানেকশোর।
১৯৪২ সালে তিনি ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে যোগ দেন আর সেই কারণে তিনি দিল্লি চলে যান। দিল্লি যাওয়ার পর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি স্থান পায় হোমাইয়ের লেন্সে।
ভারত বিভাগের জন্য সেই সময় কংগ্রেস সদস্যরা ভোট দিচ্ছিলেন, আর সেই মুহূর্তের ছবি ধরা পড়ে হোমাই এর ক্যামেরার লেন্সে। স্বাধীনতার সময়ে নতুন দেশে গড়ে ওঠা স্টিল প্লান্ট ,বাঁধ, লালকেল্লায় প্রথম জাতীয় পতাকার উত্তোলন, রাষ্ট্রপতি ভবনে মাউন্টব্যাটেনের গান স্যালুট, মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুসজ্জা,প্রভৃতি থেকে শুরু করে বিংশ শতকে ভারতে আসা বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তিনি তার ক্যামেরাবন্দি করেছেন। তার ক্যামেরায় মার্টিন লুথার কিং থেকে শুরু করে মার্শাল টিটো, জুনিয়র হো চি মিন, রেজা শাহ পাহলাভি, ক্রুশেভের মতন রাশিয়ান নেতার ছবিও ধরা পড়েছে। ১৯৫৬ সালে ভারতবর্ষে প্রথম পা রাখেন তরুণ দলাই লামা। সেই সময় হোমাই 'টাইম-লাইফের' জন্য দলাই লামার ছবি লেন্স বন্দি করেন। সে সময় ভারতবর্ষের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ছিল ' অনলুকার' এবং 'কারেন্ট'। এই বিখ্যাত ম্যাগাজিন দুটি হোমাইকে অনুরোধ করেছিল যে তাদের জন্য হোমাই যেন সুদর্শনা নারীদের আলোকচিত্র তুলে দেন। আর তাদের কথা অনুযায়ী হোমাই তার লেন্সে এক এক করে রানী এলিজাবেথ এবং আমেরিকার ফাস্ট লেডি জ্যাকি কেনেডির ছবি তোলেন। আর সেই ছবিগুলো এই ম্যাগাজিন গুলোতে স্থান পায়।
সেই সময় একমাত্র মহিলা ফটোগ্রাফার ছিলেন হোমাই ভিয়ারাওয়ালা। আর তাই হয়তো তিনি ছবি তোলার সময় শাড়ি পড়তেই ভালোবাসতেন। তিনি যেহেতু পার্শি পরিবারের জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেহেতু তার পরিবারের নারীরা শাড়ি ছাড়াও অন্য পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্তু ছবি তোলার সময় হোমাই শাড়িকেই তার পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আর এই শাড়ি পরে ফটো তোলার কারণে সহকর্মীদের কাছে তিনি হাসির পাত্র হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় সবাই তাকে মাম্মি বলে ডাকতেন।
আলোকচিত্রী হিসেবে আস্তে আস্তে নাম ডাক ছড়িয়ে পড়তে থাকে হোমাইয়ের। তার সবথেকে পছন্দের বিষয় ছিলেন জহরলাল নেহেরু। তার আলোকচিত্র গুলোর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত ছবি ছিল গান্ধীজীর শেষকৃত্যের ছবি। আর ১৯৪৮ সালে এই সমস্ত ছবিগুলোই তাকে ফটো জার্নালিস্ট হিসাবে পরিচিতি এনে দিয়েছিল।
হোমাই মনে করতেন এক বর্ণের ছবি অনেকদিন টিকে থাকে আর সেই কারণে তিনি সাদাকালো ছবি তুলতে বেশি পছন্দ করতেন। আর হোমাই এর তোলা ছবিগুলো আজও অমলিন। দিল্লির 'দ্য অ্যালকাজি ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস' কর্তৃপক্ষ হোমাই এর তোলা আলোক চিত্রগুলো তাদের 'চিরকালীন সংগ্রহ' অর্থাৎ পার্মানেন্ট কালেকশন হিসাবে সংরক্ষণ করে তাকে সম্মান প্রদান করেন।
১৯৩০ সাল থেকে অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময় থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছিলেন হোমাই। নিজের পেশাগত জীবনে বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে আউটস্ট্যান্ডিং উওম্যান মিডিয়া পার্সন হিসাবে তিনি 'চামেলি দেবী জৈন' পুরস্কার লাভ করেন।২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক দ্বিতীয় বেসামরিক পুরস্কার পদ্মবিভূষণ এ ভূষিত হন হোমাই। এছাড়াও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক দ্বারা 'ন্যাশনাল ফটো অ্যাওয়ার্ড ফর লাইফ টাইম আচিভমেন্টে' এ সম্মানিত হন তিনি।
১৯৯৬ সালে হোমাইয়ের জীবন অবলম্বন করে ডালডা থার্টিন (Dalda 13) নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে 'ব্রিটিশ আর্ট কাউন্সিল'। এবং ২০০৬ সালে 'ইন্ডিয়া ইন ফোকাস : ক্যামেরা ক্রনিক্যালস অফ হোমাই ভিয়ারাওয়ালা' নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।
হোমাই ভিয়ারাওয়ালা ছবি তোলার পেছনে প্রেরণা ছিলেন তার স্বামী মানেকশো। যিনি নিজে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার হিসাবরক্ষক এবং আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৭০ সালে মানেকশোর মৃত্যু হয়, আর তার মৃত্যুর সাথে সাথে ছবি তোলা ও ছেড়ে দেন হোমাই। নিজের কর্মজীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নেন তিনি।আসলে হোমাই চাননি আধুনিক সংস্কৃতি এবং হলুদ সাংবাদিকতার সাথে তাল মেলাতে।
স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে ফারুকের কাছে পিলানিতে চলে যান হোমাই। কিন্তু ১৯৮৯ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছেলের মৃত্যুর পর তিনি তার জন্মস্থান গুজরাটে চলে আসেন। গুজরাটের বরদা তে একটি ছোট্ট বাসস্থান তৈরি করেন তিনি। সেখানেই ছোটখাটো বাগান বানিয়েছিলেন হোমাই। সেইসব নিয়েই তার সময় কাটতো। কিন্তু ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে হঠাৎ করেই তিনি খাট থেকে পড়ে যান এবং তার ফলে উরুসন্ধির হাড় ভেঙ্গে যায় হোমাই এর। প্রতিবেশীদের সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু সেখানে ১৫ ই জানুয়ারি ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয় ফার্স্ট লেডি অফ দ্য লেন্স হোমাই ভিয়ারাওয়ালা।